ঈশানীর ভাবের সময়


 বইয়ের নাম : ঈশানীর ভাবের সময়
লেখক : খসরু চৌধুরী
প্রকাশক : সময় প্রকাশন, ঢাকা
বিষয় : উপন্যাস, সুন্দরবন
প্রকাশকাল : ২০১৭ । পৃষ্ঠা : ২৩২
আকার : অক্টাভো । টাকা ৩৫০.০০ 

“ভূখণ্ডপ্রেম, দেশপ্রেম বা জাতিপ্রেম যা-ই বলি না কেন, তা আসলে তা আত্মপ্রেমেরই অংশ। তাই তো আমাদের পাড়ার কথা, গ্রামের কথা বা নদীর কথা কোনো সাহিত্য বা ইতিহাসে দেখলে গর্ববোধ হয়, আত্মপ্রেম জেগে ওঠে। এই আত্মপ্রেম ভালো না মন্দ, ভালো হলে কোন পর্যায় পর্যন্ত ভালো, সেই প্রশ্ন আপাতত তুলে রাখছি। তবে ভূখণ্ড, দেশ বা জাতিপ্রেম যখন আত্মশ্লাঘা, আত্মগরিমা ও উচ্চমন্যতায় রূপ নেয় তখন তা সত্যিই ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়ায়। প্রেম ও গরিমার পার্থক্য বুঝে না বুঝে আমিও অনেক সময় অতিক্রম করে যাই, ওটুকুই ব্যক্তি ‘আমি’-এর নেতি। বাঙালি হিশেবে সেই ক্ষণ পৌণপুণিক আসে এমন বলার সুযোগ অবশ্য খুব কম। 

আত্মপ্রেমে গর্ব অনুভব করেছিলাম যখন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ার সময় বজলুল করিমের লেখা ‘ব্রজলাল কলেজের ইতিহাস’ পড়লাম। বজলুল করিম ছিলেন আমাদের কলেজের দর্শনের অধ্যাপক। সেই পরিচয়ে তিনি অবশ্য খুব কম পরিচিত। সাবেক জাতীয় ফুটবল খেলোয়াড় রুমি’র বাবা বললে প্রায় সকলেই চিনতে পারেন। তো, এর অনেক অনেকদিন পর সতীশচন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর-খুলনার ইতিহাস’ পড়ার সময় দেখলাম খুলনা, চালনা, দাকোপ, কয়রা, নলিয়ানের নাম। গর্ব হলো যখন দেখলাম ভৈরব, রূপসা, পশর, সুতারখালী নদী ওই বইয়ের প্রধান চরিত্ররূপে উদ্ভাসিত। 

এএফএম আব্দুল জলিলের ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’ কিন্তু ওই মাত্রায় গর্বানুভব করতে সুযোগ দেয়নি, কেননা তার অনেক তথ্যই সূত্রহীন আত্মগরিমায় ভরা। অন্য ইতিহাসবিদদের প্রতি তাচ্ছিল্য তাঁর রচনার মান নামিয়েছে অনেকখানি। সতীশচন্দ্র মিত্রের ছেলে শিবশঙ্কর মিত্রের ‘সুন্দরবনের আর্জান সর্দার’ বা ‘বনবিবি’ উপন্যাস পড়ার সময় অপ্রকাশযোগ্য নির্মলতা, ক্ষোভ আর অনুসন্ধিৎসা ভর করেছিলো সারা শরীরে। ওই উপন্যাসগুলো আজকের পশ্চিমবঙ্গবাসী বাদাবনাগ্রহীদের দুঃখই কেবল বাড়াবে। 

এরপর একদিন হাতে এলো মনোজ বসুর ‘নিশিকুটুম্ব’। করুণ ও নিষ্ঠুর জীবনের শিকার সাহেব যখন বড়ো পরবের জন্য বড়দল (উচ্চারণ বড়্দল) হাটে যায় তখন ইতিহাসের এক বিলুপ্ত গঞ্জের কথা মনে করে গর্ব হয়। কপোতাক্ষ নদের পাড়ের বড়দল এখন নিতান্ত এক হাট। একদা স্টিমার আসতো কোলকাতা থেকে, সমাগম হতো গেঁয়ো চাষা আর মহাজনের। খুলনা মহানগরীর বহু আগেই কপিলমুণি বিদ্যুতায়িত হয়েছিলো, এ তথ্য জানলে গুপ্তধন পাবার আনন্দ হয়। সুন্দরবনের প্রেক্ষাপটে মনোজ বসুর আরো উপন্যাস আছে, বিশেষত ‘বন কেটে বসতি’, এ সংবাদ জানলাম এই তো সেদিন। 

সেই আনন্দ, সেই গর্ব, সেই আত্মপ্রেম জেগে উঠলো যখন পড়তে শুরু করলাম শ্রদ্ধেয় খসরু চৌধুরীর ‘ঈশানীর ভাবের সময়’। মংলা শহর থেকে ষোল কিলোমিটার দক্ষিণে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জ অফিস, চিলা-চাঁদপাই ইউনিয়নের পটভূমিতে গড়ে উঠেছে উপন্যাসটি। নদীর ওপারের দাকোপের লাউডোব-বানিশান্তা ইউনিয়ন, কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের আংটিহারা, চার নম্বর কয়রা - এসেছে ঘটনার সাথে সাথে প্রসঙ্গক্রমে। এসেছে মংলা নদী, শেলা নদী, মৃগমারি খাল, খড়মা খাল, কালামিয়া ভারানি, মরা পশর, আন্ধারিয়া, হরিণটানা, চানমিয়াখালী, সুপতি, কচিখালী, দুবলার চর আরো কতো জায়গা! এ সেই মাটি, যা আমার সারা গায়ে লাগানো, ছাতিলগ্ন দাঁড়ালে এখনও যার গন্ধ পাওয়া যায় আমার শরীরে। 

উপন্যাস পড়তে পড়তে আমার মনে পড়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘খোয়াবনামা’র তমিজ আর কুলসুম, নাকি হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’র ‘মেথর বউ’, নাকি মহাশ্বেতা দেবীর ‘অরণ্যের অধিকার’-এর ‘বিরসা মুণ্ডা’কে। মাঝে মাঝে যেন দেখতে পাই শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’র ‘লীলাবতী’কে। এদের কারোরই গন্ধ নেই ‘ঈশানীর ভাবের সময়’ উপন্যাসে। উপন্যাসগুলোর প্রেক্ষিত ভিন্ন, পটভূমি ভিন্ন, ভিন্ন তাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও। কিন্তু সব মাটির গন্ধ বোধহয় এক, কারণ তাদের লড়াইগুলো শেষ পর্যন্ত একইরকম। 

উপন্যাসের শুরুতে ঈশানীর পরিচয় পাই না। কিন্তু যখন পাই তখনই মনে হয়, ঈশানী দক্ষিণের এক সবল কালো মেয়ে, যেন দেবী কালীর মতো। যে সামনের বাধা গুড়িয়ে যায় - অদম্য জলস্রোতের মতো। জল কেবল অশ্রুর হয় না, প্লাবনের জলও জল। কিন্তু প্লাবন ছাড়াও জল দৈনিক জোয়ার-ভাটারূপে চলতে থাকে এই দক্ষিণাঞ্চলে। সেই জোয়ারের জল কী প্রবল প্রতাপে মানবের সাধের বেড়িবাঁধ ভেঙে নিয়ে যায়, আংটিহারা গ্রামের মাঝখান থেকে সোজা চিরে দিয়ে তৈরি করে দুটো গ্রাম, সে তো জানা সবার। ঈশানীও তেমনি; এমনিতে কোমল নারীরূপিনী তার বহিরাঙ্গ। কিন্তু জোগার গোনে (জোবা বা জোখাও বলা যায়) জোয়ারের তোড়ে সে সব সামাজিক বাঁধন ছিড়ে চলে যায় আপন গতিতে। 

উপন্যাসের শুরুতেই বাদাবন-সংলগ্ন এক চিরাচরিত গ্রামের রূপ। বাঙলার যে কোনো গ্রামই হতে পারতো, কিন্তু হয়নি। হয়নি তার কারণ, এ গ্রামে অন্য সব গাছপালার সঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কেওড়া আর গেওয়া। ধানের ক্ষেতের জলায় শোল-টাকির সাথে বেড়ে ওঠে নোনাট্যাংরা আর মেদিকাঁকড়ার ঝাঁক। রাত বাড়লেই পাল্লা দিয়ে বাড়ে বাঘের ভয়, লোকে যারে সম্ভ্রমের সঙ্গে ডাকে বড়োমামা বলে। গ্রাম-সংলগ্ন খড়মা খাল পেরিয়ে মাঝে মাঝেই বাঘ গ্রামবাসী আর তাদের গবাদিপশুর সংখ্যা কমিয়ে দিতে চায়। ওদিকে গ্রামের মানুষও বাঘের আবাসে ঢুকে মাঝে মাঝেই হরিণ মারে, তাতে যুক্ত হয় সরকারের পাহারাদারেরাও। এই তিক্ত সত্যই উপন্যাসের পটভূমির বিশেষত্ব নির্ধারণ করে দেয়। 

বিস্তীর্ণ ধানের ক্ষেত আর তার চারপাশের বর্ণনা দিতে দিতে লেখক আমাদেরকে গ্রামের ভেতরে নিয়ে যান। লেখক যেন দিব্যচোখে দেখতে পান দিগন্ত জুড়ে শুয়ে আছেন নগ্না পৌষলক্ষ্মী দেবী। আর তাঁকে পাহারা দেয় লম্বা নাকের পুরুষ পাহারাদার। জানতে পারি, সে এক লক্ষ্মীপেঁচা। কিন্তু লক্ষ্মীপেঁচা জেনেও প্রশ্ন যায় না। জানতে ইচ্ছে হয়, এই পাহারাদার কি শ্রেফ দেবীর নিরাপত্তা দেয় নাকি সে বাঙলারূপী দেবীর আগ্রাসী পাহারাদার আর্য্যপুরুষ? নাকি দেবীরূপে আছে ঈশানী আর পাহারাদার তার আরাধ্য পুরুষ শাহরিয়ার? 

শুধু পৌষলক্ষ্মী না, পুরো উপন্যাসজুড়ে অলক্ষ্যে কাহিনীর মধ্যে ঢুকে পড়েন বনবিবি, দক্ষিণ রায়, বিশালাক্ষী আর প্রচলিত দেবদেবীগণ - ব্রহ্মা, ইন্দ্র, গঙ্গা, কপিল মুণি, সগর রাজা, রাম, ভগীরথ। আর সাথে সাথে আসেন প্রতাপাদিত্য, মোরেল, ইংরেজ আর খ্রিস্টান মিশনারিরা। আজকের বাদা অঞ্চলে লোক-বিশ্বাসের দাপট কমে গেছে। প্রথাগত বিধি আর চর্চার জায়গা দখল করেছে আইন-কানুন, সরকারি আদেশ। কিন্তু প্রথাগত উৎসবগুলো আজও দেখতে পাওয়া যায় খুলনা, সাতক্ষীরা বাগেরহাটের দক্ষিণী গ্রামগুলোতে। সুন্দরবনের পশ্চিম থেকে পুবের দিকে যতো যাওয়া যায় ততোই কমতে থাকবে প্রথাগত বিশ্বাস। বাদার সঙ্গে ঐতিহ্যগত সম্পর্কহীন মানুষেরা বাসা বেঁধেছে প্রধানত পুবে। তাই তো সংস্কারের ধার ধারে না তারা ”